লেখা: পৃথা পারমিতা নাগ
প্রত্যেক মা-বাবাই চান সুস্থভাবে বেড়ে উঠুক তাঁর সন্তান। মেধায়-মননে হয়ে উঠুক অনন্য। তবে সন্তানের বেড়ে ওঠা বলতে অনেক মা-বাবা শুধু শারীরিক বেড়ে ওঠাই বোঝেন। তাই সন্তানের বেড়ে ওঠার এই যাত্রায় প্রাধান্য পায় খাওয়াদাওয়া। তবে সন্তানের সার্বিক সুস্থতা শুধু সুষম খাবারের ওপরই নির্ভর করে না। যে পরিবেশে সে বেড়ে উঠছে, তার ওপরেও নির্ভর করে তাদের বিকাশ।
শিশুর জীবনের প্রথম পাঁচ বছর তার বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়েই শিশুর প্রায় ৮০ ভাগ মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইইউ)–এর গবেষণা বলছে, শিশুর জন্মের প্রথম দুই বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শিশুর সঙ্গে তার পরিবারের মানুষগুলোর বন্ধন শিশুর ভবিষ্যতের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশে যত্নশীল না হলে সে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় ভুগতে পারে। এমনকি তার সম্ভাবনাময় গুণাবলিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কেন গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক বন্ধন?
জন্মের পর শিশুর সঙ্গে পরিবারের মানুষগুলোর সম্পর্কই হয় তার প্রথম পাঠ। মা-বাবা এবং পরিবারের অন্যান্য মানুষের সান্নিধ্যে থেকে এরা নিজের এবং বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা পায়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে শিশুরা শেখে, কীভাবে অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। একটা শিশু যখন হাসে, কাঁদে, জিদ করে বা কোলে উঠতে চায়—তখন সে খেয়াল করে তার চারপাশের মানুষ তাকে কী ‘উত্তর’ দিচ্ছে। এটাই তার জন্য শেখার প্রথম ধাপ। কীভাবে ভাবতে হয়, বুঝতে হয়, কথা বলতে হয়, আবেগ প্রকাশ করতে হয়—এসব সামাজিক আচরণ ও যোগাযোগের দক্ষতা তাদের জন্মের প্রথম কয়েক বছরেই গড়ে ওঠে।
তবে শুধু সন্তানের সঙ্গেই নয়, আশপাশের মানুষের সঙ্গে আপনার আচরণও প্রভাব ফেলে সন্তানের বিকাশে। আপনার সঙ্গী, বন্ধু, পরিবারের অন্যান্য সদস্য, ঘরের কাজে সহায়তাকারীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছেন, তা শিশুরা খেয়াল করে। অনুকরণ করে। এভাবে তারা পরিবার এবং বাইরের মানুষের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হয়, শিখে নেয়। হালে এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে গ্যাজেট। ইউটিউব বা মুঠোফোন থেকেও অনেক শিশু নানা বিষয়ে শিখে থাকে।
শক্ত পারিবারিক বন্ধন
ব্যস্ততায় মোড়া এই শহুরে জীবনে আলাদা করে সময় খুঁজে বের করা কঠিন। তার চেয়ে বরং তৈরি করে নিন নিজস্ব কিছু ঘরোয়া রীতি। এতে যেমন আলাদা করে সময় খুঁজতে হয় না, তেমনি সবাইকে একসঙ্গে বেঁধে রাখতেও এটি খুবই কার্যকর।
একসঙ্গে খেতে বসুন: কর্মজীবী মা-বাবার ক্ষেত্রে সকাল বা রাতের খাবারই হয়তো একমাত্র সময়, যখন পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসার সুযোগ পান। এই সময়টুকু মুঠোফোন বা অন্যান্য কাজ থেকে বিরত থাকুন। সন্তানকে গল্প বলুন, সারা দিন সে কী কী করেছে বা করতে চাইছে, জেনে নিন। পাশাপাশি সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন নিজের কোনো মজার ঘটনা বা অভিজ্ঞতা। এতে খেতে বসলেই টিভি বা মুঠোফোনের প্রতি শিশুর আকর্ষণ কমে আসবে। সে খাওয়ায় মনোযোগী হতে শিখবে, পাশাপাশি এই সময়ের গল্প, হাসিঠাট্টা শিশুকে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকতে সাহায্য করবে।
আচার-ঐতিহ্য পালন: প্রত্যেক পরিবারেই কিছু আচার-ঐতিহ্য থাকে। শিশুকে ছোটবেলা থেকে সেসব পালনে উৎসাহিত করুন। পয়লা বৈশাখ, জাতীয় দিবস, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পারিবারিকভাবে উদ্যাপিত দিনগুলো সবাই একসঙ্গে পালন করুন। শিশুকে শোনান এই বিশেষ দিনগুলোর তাৎপর্য। ইতিহাস জানার পাশাপাশি এতে তার মধ্যে স্বকীয়তা বোধ তৈরি হবে।
সবাই মিলে ঘরের কাজ: শিশুকে ঘরের কাজে উৎসাহিত করতে সবাই মিলে ঘরের কাজ ভাগ করে নেওয়ার বিকল্প নেই। ঘরের কাজে সহায়তাকারী থাকলেও বয়স অনুযায়ী ঘরের নানান কাজে আপনার শিশুকেও যুক্ত করুন। এতে শিশু যেমন দায়িত্ব নিতে শিখবে, তেমনি তার মধ্যে সবার সঙ্গে কাজ করার গুণ ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠবে।
ঘুরতে যান, একসঙ্গে খেলুন: পরিবারের সবাই মিলে ঘুরতে যান। এতে মুঠোফোন, ট্যাব ব্যবহারের আসক্তি কমবে। সব সময়ই যে দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে হবে, এমন নয়। শিশুকে নিয়ে পার্ক, চিড়িয়াখানা, জাদুঘরে যেতে পারেন। ঘোরার পাশাপাশি শিশুকে সক্রিয় রাখতে তার সঙ্গে খেলুন। বাসার ছাদেই খেলতে পারেন। এতে সে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকবে।
আরও যা করতে পারেন: শিশুর সঙ্গে কোনো প্রোজেক্ট করুন। শিশু ছোট হলে তার সঙ্গে লুকোচুরি, রং করা, পাজল মেলানো, গান শোনানো, নানান জিনিসের নাম শেখানোর মতো কাজে কাটতে পারে দারুণ সময়। আর সন্তান একটু বড় হলে তার সঙ্গে শব্দের খেলা খেলুন, কাগজ বা কাপড় কেটে বানান মজার মজার জিনিস, লেগো মেলান, বোর্ড গেম খেলুন। বাগান পরিচর্যা করা, ঘরে কোনো প্রাণী থাকলে এগুলোকে খাবার দেওয়া, স্কুলের কোনো কাজে সাহায্য করার মতো ব্যাপারে সন্তানের পাশে থাকুন, তাকে উৎসাহ দিন। এসব কাজ করার সময় তার সঙ্গে কথা বলুন। তাকে ভাবার সুযোগ করে দিন।
সন্তান পালনে প্রত্যেক মা-বাবা অবর্ণনীয় কষ্ট করেন। তবে শিশু যখন দায়িত্বশীল, ইতিবাচক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে ওঠে, তখন কষ্টটাকে মনে হয় সার্থক!
আরেকটা কথা। শুধু সন্তানকে না শিখিয়ে তার থেকে আপনি যা আশা করেন, তা নিজেরা পালন করুন। ভালো অভ্যাস তৈরি করার জন্য অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখুন। তবে মনে রাখবেন, শিশু লালনপালনের ক্ষেত্রে সব সময় আপনি নিখুঁত হতে পারবেন না। বাইরের প্রভাব থেকেও শিশুকে সব সময় দূরে রাখা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নিজের এবং সন্তানের প্রতি কঠোর না হয়ে বরং সহনশীল হোন। ভুল থেকেও শিখুক।
Source: https://www.prothomalo.com/lifestyle/relation/ehpp2utejg